বিশ্বজুড়ে নানা দেশে যখন দীর্ঘস্থায়ী শাসকদের স্বৈরাচারী, একনায়ক আখ্যা দিয়ে ক্ষমতা থেকে টেনেহিঁচড়ে নামানো হচ্ছে, তখন বেশ নীরবেই শাসনের সুবর্ণজয়ন্তী পূর্ণ করে বেশ নিভৃতেই এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যান ওমানের সাবেক সুলতান কাবুস বিন সাঈদ। তার মৃত্যুতে শুধুমাত্র ওমানের নাগরিকই কেঁদেছে ব্যাপারটা এমন নয়। দেশটিতে বসবাসরত সকল প্রবাসীরাই কেঁদেছিলো তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে। মাত্র ২৯ বছর বয়সে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পিতা সাঈদ বিন তাইমুরকে সরিয়ে ১৯৭০ সালে সুলতান হয়ে বসেন কাবুস।
আরো পড়ুনঃ ইসলামিক কুইজে অংশগ্রহণ করে জিতে নিন নগদ অর্থ পুরষ্কার!

ওমানের প্রয়াত সুলতান কাবুস বিন সাঈদ
সুলতান কাবুস ১৯৭০ সালে যখন ওমানের সিংহাসনে আরোহন করেন তখন দেশটিতে মাত্র ১০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা আর তিনটি স্কুল ছিল। কৃষক আর জেলেদের দেশ হিসেবে পরিচিত ওমানে তখন অবকাঠামো বলতে তেমন কিছু ছিল না। বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন ওমান তখন দারিদ্র্য পীড়িত একটি দেশ। কিন্তু সেই গরিব ওমান আজ আরব বিশ্বের একটি আধুনিক ধনি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। উন্নত অবকাঠামো আর নাগরিকদের স্বচ্ছল জীবন যাপনের জন্য ওমান অন্যতম সুখী আর শান্তিপূর্ণ একটি দেশ। ওমানের আজকের যত পরিচিতি তার মুলে রয়েছেন সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ।

১৯৭১ সালের ওমানের চিত্র
সুলতান কাবুসের শিক্ষা জীবন কাটে বৃটেনে । তিনি বিটিশ সেনাবাহিনীরও একজন সদস্য ছিলেন। বৃটেন থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে একজন আধুনিক উদারমনা যুবক হিসেবে ফিরে আসেন রক্ষণশীল ওমানে। দেশ গঠনে তিনি কাজে লাগান তার শিক্ষা ও আধুনিক চিন্তা চেতনা। ক্ষমতা আরোহণের পরপরই কাবুস মনোনিবেশ করেন ওমানের তেল সম্পদ ব্যবহারের দিকে। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশকে একটি আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ওমানকে টেনে বের করে আনলেন বিশ্ব দরবারে।

ছাত্র জীবনে সুলতান কাবুস
অশিক্ষিত জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে তিনি মনোযোগ দিলেন শিক্ষায়। গড়ে তুলতে লাগলেন দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের অবকাঠামো। তেলের আয় দিয়ে গড়তে লাগলেন রাস্তা ঘাট, নদী বন্দর, বিমান বন্দর, হাসপাতালসহ নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বিদ্যুৎ, টেলিকমিউনিকেশনসহ সব দিক দিয়ে দেশকে একটি শক্ত অবকাঠামো ও ভিত্তির ওপর দাড় করালেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও তিনি উৎসাহিত করলেন । ফলে গড়ে উঠতে লাগল ব্যাংক, হোটেল, ইনস্যুরেন্স, পর্যটন অবকাঠামোসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান।

ওমানের রাস্তার বর্তমান চিত্র
কাবুস অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন করেছেন, তেমনি দেশের পুরনো অনেক রীতিনীতিও পাল্টে দেন। দাসপ্রথা উচ্ছেদ করেন। রক্ষণশীল বৃত্ত ভেঙে জনগণকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেন তিনি। আবার নিজেদের পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি রচনা করেন নতুন এক ধারার। ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি আজীবন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে যুক্তরাজ্যকে সব কিছুতে প্রাধান্য দিয়েছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও সুলতান কাবুস
আবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো লোকদেরও নিমন্ত্রণ জানিয়ে দেশে নিয়ে আসেন তিনি। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সুলতান কাবুস পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছিলেন নিরপেক্ষ নীতি। নিজের রচিত পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি লিখেছিলেন, তার দেশ ব্রিটেনের প্রতি অনুরাগী। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর মেজবান হতে আগ্রহী আবার ইরানের আয়াতুল্লাহ ও চীনের ব্যবসায়ীদের সাথে সাক্ষাৎ করেও তারা খুশি।

ইসরাইলের প্রতিনিধি দলের সাথে সুলতান কাবুস
এ ধরনের পররাষ্ট্রনীতির কারণে সমালোচনার মুখে পড়লেও এর কারণেই তিনি বিশ্ব রাজনীতির কঠিন ক্ষেত্র মধ্যপ্রাচ্যের মতো জটিল জায়গাতেও নিজের অন্য ধরনের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবার তার কূটনৈতিক দক্ষতাও ছিল ঈর্ষণীয়। মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক বড় বড় ইস্যুতে তার কূটনৈতিক তৎপরতা পেয়েছে বড় ধরনের সফলতা। ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু অস্ত্র নিরোধ চুক্তি কিংবা ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধ করার পেছনে তার অবদান ছিল অসামান্য।

বর্তমান ওমানের চিত্র
বর্তমানে আবার ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে অনেকে অনুভব করছেন কাবুসের শূন্যতা। কিন্তু তার এসব অবদানকে তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতেই ভালোবাসতেন। সে কারণে বিশ্ববাসীর কাছে সেসব খবর তেমনভাবে পৌঁছত না। কিন্তু বিশ্ব নেতাদের কাছে তার মূল্যায়ন ছিল বেশ উচ্চ পর্যায়ের। আবার দেশ শাসনের ক্ষেত্রেও তাকে বেশ সফলই বলা চলে। কারণ তিনি ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সাহায্য নিয়ে ওমানের দক্ষিণাঞ্চলে উপজাতিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমন করেন।
আরো পড়ুনঃ প্রাকৃতিক সুন্দরের অপরূপ লীলাভূমি ওমান
আবার ২০১১ সালে আরব বসন্তের তোড়ে যেখানে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো এশিয়াই শাসকগোষ্ঠীর জন্য জাহান্নাম হয়ে উঠেছিল, সে সঙ্গিন মুহূর্তেও তিনি সে চাপ সামাল দিয়েছেন বেশ ভালোভাবেই। সব মিলিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমাদৃত থেকেই এ দুনিয়া ছেড়ে যান ১৯৪০ সালের ১৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করা কাবুস বিন সাঈদ। ওমান একটি বিশাল আয়তনের দেশ হলেও জনসংখ্যা মাত্র ৪৬ লাখ। আর এর মধ্যে ৪৩ ভাগ হলো বিদেশী নাগরিক। ওমানের আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুনেরও বেশি তথা এক লাখ ১৯ হাজার ৫শ বর্গমাইল। ফলে অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদকে তিনি দেশটির এ সীমিত জনসংখ্যার ভাগ্য উন্নয়নে কাজে লাগাতে পেরেছেন।

ওমানের মানচিত্র
ওমানকে আজকের একটি উদার, আধুনিক আর ধনি রাষ্ট্রের কাতারে পৌঁছানোর জন্য অনেক সুবিধাও পেয়েছেন কাবুস। এর মধ্যে প্রথমে রয়েছে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে একটানা দেশ শাসনের সুযোগ। এ ক্ষেত্রে তিনি উপভোগ করেছেন একচ্ছত্র আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার চর্চা। আর একটানা দীর্ঘ ৫০ বছর দেশ শাসনের রেকর্ড গড়ে তিনি আরব বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি গোটা বিশ্বেও সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসকে পরিণত হন। ৭৯ বছর বয়সে ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর আলোচনায় এসেছেন আরব বিশ্বের নিভৃতে থাকা এ শাসক।

সুলতান কাবুসের পুরনো ছবি
২০১৮ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ওমান সফরের আমন্ত্রন জানিয়ে অনেককে তাক লাগিয়ে দেন প্রয়াত কাবুস। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনারও শিকার হয়েছেন তিনি। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। নেতানিয়াহু ওমান সফর শেষে দেশে ফেরার এক দিন পর ওমানের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় ইসরাইল বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র। নেতানিয়াহুর আগে ওমান ভ্রমন করেছিলেন আরেক ইসরাইল প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজ ১৯৯৬ সালে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার জন্য পশ্চিমা বিশ্বে সুনাম অর্জন করেন কাবুস।
আরও পড়ুনঃ শান্তিপ্রিয় একটি দেশের নাম ওমান
কাবুসের দীর্ঘ শাসন আর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু রহস্য। ২৯ বছর বয়সে ক্ষমতা আরোহনের পর ৩৫ বছর বয়সে তিনি তার চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের মধ্যে। এরপর কাবুস আর কখনো বিয়ে করেননি। নেই তার কোনো সন্তানাদিও। তিনি সরাসরি ওমানের ৪শ বছরের পুরনো রাজ বংশের বংশধর হলেও নিজের বংশধারা রক্ষার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি। বিয়ের পর কেন দ্রুত ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল এবং কেনই বা আর বিয়ে করলেন না এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের কথা চালু রয়েছে।

সুলতানের স্ত্রী, ছবিঃ M.Zabanoot
একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হলেও তিনি সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে আসতেন প্রায়ই এবং সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতেন। অনেক সময় তিনি নিজেই নিজের গাড়ি চালাতেন। ক্ষমতায় বসে ওমানকে একটি আধুনিক উদার আর ধনি রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন কাবুস। অনেকে একে রেনেসাঁর সাথে তুলনা করে থাকেন।
সুলতান কাবুস মারা গেছেন ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সরকারব্যবস্থায় পরিবারতন্ত্র খুব জোরালো থাকলেও কাবুসের কোনো সন্তান বা ভাই না থাকায় সরাসরি পরিবারতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তা কার্যকরের কোনো সুযোগ ছিল না ওমানে। তবে ক্ষমতা একেবারে গোষ্ঠীর বাইরেও চলে যায়নি। কারণ নতুন সুলতানের তালিকায় ছিলেন কাবুসের তিন চাচাতো ভাই ওমানের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী হাইতাম বিন তারিক তৈমুর আল-সাঈদ, উপপ্রধানমন্ত্রী তারিক আল সাঈদ ও সাবেক নৌকমান্ডার সিহাব বিন তারিক আল সাঈদ।

সুলতানের কবর
ওমানের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশটিতে তিন দিনের বেশি সুলতান পদ খালি রাখার নিয়ম নেই। কাবুস মৃত্যুর অনেক আগেই তার উত্তরসূরি নির্বাচন করে একটি চিঠি লিখে রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পরই সে চিঠিটি খোলা হয়েছিল। তাতেই হাইতাম বিন তারিককে সুলতান হিসেবে মনোনীত করার নির্দেশনা পাওয়া যায়। প্রয়াত সুলতানের সে নির্দেশনার বিরোধিতা করেননি কেউই।

ওমানের নতুন সুলতান হাইথাম বিন তারেক
ওমানে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সুলতানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে। ওমানের সুলতান একই সাথে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার এবং প্রতিরক্ষা, অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। নতুন সুলতান হাইতাম দায়িত্ব নেয়ার পর তার প্রথম ভাষণে বলেছেন, তিনি তার পূর্বসূরির ধারাই চালু রাখবেন। কারণ ওমানের লোকজন এই পররাষ্ট্রনীতিতেই খুশি। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংঘাত থেকে দূরে থাকা এবং বিভিন্ন সঙ্কটে মধ্যস্থতা করার ভূমিকায় তারা গর্বিত।
আরো দেখুনঃ সুলতান কাবুসের সেই রহস্যময় চিঠিতে কি লেখা ছিল?